ভূমিকা :
রোহিঙ্গারা মূলত পশ্চিম মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বাসিন্দা। মায়ানমারের বাসিন্দা হওয়া সত্বেও ১৯৮২ সালে সেদেশে আইন পাশ করে তাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করা হয়। ফলশ্রুতিতে ১৯৭৮,৯১-৯২ ও ২০১২,২০১৫ এবং সর্বশেষ ২০১৬-২০১৭ তে তাদের উপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়। এর ফলে সেদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা উল্লিখিত সময়গুলোতে বাংলাদেশসহ পাশ্ববর্তী কয়েকটি দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। রোহিঙ্গারা মূলত মুসলমান,তবে অল্প হিন্দুও রয়েছে। তাই ধর্মের কারণে এবং রাখাইন রাজ্যটি বাংলাদেশের পার্বত্য জেলাগুলোর সীমান্তবর্তী হওয়ায় বিপুল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নির্যাতন, নিপীড়ন সহ্য করতে না পেরে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। আর এইবছর তাদের প্রবেশ অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে। প্রায় চার লক্ষ (মায়ানমারের রোহিঙ্গার ৪০%) এইবছর
বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে।
আর তাই রোহিঙ্গা ইস্যুটি বর্তমানে বাংলাদেশে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত
হয়েছে। বুদ্ধিজীবী, টিভি ব্যক্তিত্ব, রাজনৈতিক, ব্যবসায়ী,সাধারণ মানুষ সর্বোপরি সব পেশার মানুষ এখন এই বিষয়টি নিয়ে সচেতন। ফলে তাদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। শুধু দেশেই নয় আন্তর্জাতিকভাবেও এই
ইস্যুটি নিয়ে আলোচনায় বাংলাদেশের কথা উঠে আসছে।
রোহিঙ্গা কারা :
রোহিঙ্গারা রাষ্ট্রহীন মানুষ। মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে তাদের বসবাস।রাখাইন
রাজ্যের আদি নাম আরাকান।যদিও রোহিঙ্গাদের পূর্বপুরুষরা শত শত বছর ধরে সেখানে আছে
কিন্তু মায়ানমার সরকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠিকে কখনো নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি;অদূর ভবিষ্যতে দেবেও না।রাষ্ট্রহীন
মানুষ হিসেবে রোহিঙ্গারা রাখাইন রাজ্য সহ প্রতিবেশী বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের
বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে বাস করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় (১৯৩৯-১৯৪৫) পট পরিবর্তন হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় জাপানী আগ্রাসনের মুখে
ব্রিটিশ বাহিনী আরাকান ছেড়ে যায়।ব্রিটিশ সৈন্য
প্রত্যাহারের পর বৌদ্ধরা মুসলিমদের আক্রমন শুরু করে। ধীরে ধীরে মুসলিম ও বৌদ্ধরা
একে অপরের বিরুদ্ধে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। কিছু মুসলিম মিত্রশক্তির পক্ষে জাপানের
বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি করতে শুরু করে।যখন জাপান এটা জানতে পারে তারা সকল
মুসলিমদের উপর হত্যা,ধর্ষণসহ নিষ্ঠুর নির্যাতন চালাতে লাগে।প্রায় ৪০,০০০ রোহিঙ্গা তখন চট্টগ্রামে পালিয়ে গিয়েছিল।
১৯৪৮ সালে বার্মা স্বাধীন হলে সেসময়ের সরকার ঘোষণা করে যে রোহিঙ্গারা হচ্ছে
ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে‘সম্প্রতি’ আসা একটি উপজাতি এবং এদের স্থানীয় আদিবাসী
গণ্য করা বা বার্মার নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ১৯৬২
সাল পর্যন্ত মুসলিমরা আরাকানে একটি আলাদা রোহিঙ্গা রাষ্ট্রের দাবি জানিয়ে
আসছিল।১৯৬২ সালে সামরিক জান্তা Newin ক্ষমতা দখল করে সেই দাবী পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান
করেন এবং তার সৈন্যদের নির্দেশ দেন মুসলিমদের কঠোর ভাবে দমন করতে। রোহিঙ্গাদের
সম্পত্তি জোর করে কেড়ে নেওয়া হতে থাকে। তাদের নিজ ভুমি থেকে উৎখাত করে
শরণার্থীশিবিরে রাখা হয় এবং বাধ্যতামূলক শ্রমে নিয়োজিত করা হয়। রোহিঙ্গারা তখন
থেকেই এদিকে সেদিকে পালিয়ে যেতে থাকে।থাইল্যান্ড ও মালয়শিয়াতেই বেশী গেছে।
সাম্প্রতিক সমস্যা ২০১২ তে শুরু। জাতিগত দাঙ্গা লাগে বৌদ্ধ ও মুসলিমদের মাঝে।
মুসলিমরা প্রান হারায় হাজারে হাজারে। পালিয়ে যেতে চায় বাংলাদেশে। বাংলাদেশ তাদের
ফিরিয়ে দেয়। তারা পাড়ি দেয় থাইল্যান্ডের দিকে।বেশীর ভাগ রোহিঙ্গাই থাই মাফিয়াদের
হাতে পরে। নির্যাতিত হতে থাকে আরও বেশী।
রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ:
এই পর্যন্ত মোট চারটি ধাপে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করে-
১ম বার: ১৭৮৪ সালে রাজা বোদাওপায়া আরাকান দখল করে তাঁর
রাজধানী গঠন করলে।
২য় বার: জাপান বার্মা (মিয়ানমার) দখল করে ব্রিটিশদের
বিতাড়িত করলে ২২০০০ রোহিঙ্গা বাংলাদেশ প্রবেশ করে।
৩য় বার: জেনারেল নে উইন ১৯৭৮ সালে অপারেশন ড্রাগন কিং-এর
মাধ্যমে নাগরিকত্ব নথিবদ্ধ করার মাধ্যমে আদম শুমারি করার প্রাক্ষালে বিদেশিদের
বাছাই করার মাধ্যমে। এই সময় প্রায় ২০০০০০ রোহিঙ্গা বাংলাদেশ অনুপ্রবেশ করে
পরে GOB ও UN-এর চাপে ফেরত নিতে বাধ্য হয়। সেবারও অনুপ্রবেশকারীরা তাদের হত্যা ধর্ষনের
অভিযোগ আনেন।
৪র্থ বার: ১৯৯১-৯২ সালে The State Law and Order Restoration Council (SLORC) উত্তর রাখাইন রাজ্যে মুসলিম
সন্ত্রাসীদের দমনের জন্য সামরিক উপস্থিতি বাড়িয়ে দেয়। এই সময় তারা বাংলাদেশ
বর্ডার অব্দি নানা সামরিক স্থাপনা নির্মান করে। এই সময় রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছাশ্রমে
বাধ্য, জমি দখল, স্থানান্তর, শারীরিক নির্যাতন, হত্যা ধর্ষন করে। মসজিদ ভেঙ্গে
দেওয়া হয়, ধর্মিয় কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়, মুসলিম নেতাদের লাঞ্ছিত করা হয়।
বর্তমানে বাংলাদেশের কক্সবাজারে দুটি ক্যাম্পে ২৯০০০ হাজার রোহিঙ্গার বসবাস।
তারা ৯১-৯২ সালে আসা ২৫০০০০ রোহিঙ্গা-এর অংশ। বাংলাদেশ সরকারের হিসাবে
বর্তমানে ২০০০০০ রোহিঙ্গা কক্সবাজারের বিভিন্ন গ্রামে বসবাস কছে। উত্তর রাখাইন
রাজ্যে মোট রোহিঙ্গার সংখ্যা ছিল ৮০০০০০ তাঁর প্রায় ৩০% বাংলাদেশে
অবস্থান করছে সেই ১৯৭৮ কিংবা ৯১/৯২ সাল থেকে তাদের নিজ দেশে ফেরত
যাওয়ার কোন লক্ষন নেই। মিয়ানমার সরকার নেওয়ার বিন্দু মাত্র ইচ্ছা পোষন করে না।
রোহিঙ্গা সংকটে
বাংলাদেশের করণীয়:
রোহিঙ্গা
শরণার্থী সমস্যা বাংলাদেশের জন্য নতুনও নয়, আকস্মিকও নয়। ১৯৭৪ সালে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা
কর্তৃক ইমার্জেন্সি ইমিগ্রেশন অ্যাক্ট পাস করার পর থেকে বাংলাদেশে নানা সময়ে নানা
মাত্রায় রোহিঙ্গা শরণার্থীরা আশ্রয় নেওয়া শুরু করে।
এভাবে যতবারই রোহিঙ্গা শরণার্থীর ঢল নেমেছে,যে
সরকারই থাকুক আর যে সিদ্ধান্তই নিক,দেশের
ভেতরে ও বাইরে থেকে বাংলাদেশ নানামুখী সমালোচনার শিকার হয়েছে।এর মধ্যে ২০১২ সালের
জুন মাসে যখন প্রায় ৩২ হাজার রোহিঙ্গার মুখের ওপর বাংলাদেশ সীমান্ত বন্ধ করে দেয়;কোস্ট গার্ড নারী, শিশু ও বৃদ্ধবোঝাই জলযান অসীম সমুদ্রে ফিরিয়ে দেয়, তখন সম্ভবত সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পড়ে। পরিস্থিতির আরো
অবনতি ঘটে যখন নানা ঘটনাপরম্পরায় বাংলাদেশ এ দেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের
জন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক খাদ্য সরবরাহ নিষিদ্ধ করে, তুরস্কের একজন কূটনীতিকসহ প্রায় ১৭ জন বিদেশি নাগরিককে আটক করে এবং মেদসাঁ
সঁ ফ্রঁতিয়ে (ডক্টরস উইদাউট বর্ডার),আকসিঁও
কন্ত্র ল্য ফ্যাঁ (অ্যাকশন অ্যাগেইনস্ট হাঙ্গার) সহ বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থার
কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়।সে তুলনায় এবার,অর্থাৎ
২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর মিয়ানমারে ঘটে যাওয়া ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যে শরণার্থী সংকটের
সূচনা হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকা ছিল অনেক পরিপক্ব। তা সত্ত্বেও দেশে-বিদেশে
সমালোচনা যে হয়নি তা নয়;তথাপি এর চেয়েও গঠনমূলক ও মানবিক অবস্থান নেওয়ার সুযোগ যে বাংলাদেশ সরকারের
রয়েছে,সে বিষয়ে আলোকপাত করাই এ প্রবন্ধের উদ্দেশ্য।
বাংলাদেশের
করণীয়গুলো বুঝতে হলে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সমালোচনাগুলো কী, কারা কী উদ্দেশ্যে তা
করছে, রোহিঙ্গা
ও তাদের নিয়ে উদ্ভূত সমস্যার উৎস, মিয়ানমার
ও বাংলাদেশ তাদের পরিস্থিতি ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা থাকাটা জরুরি। দেশের ভেতর এক
দল, মূলত
উগ্র ইসলামপন্থী হিসেবে যাদের পরিচিতি আছে, তারা ধর্মীয় নৈকট্যের দোহাই দিয়ে মুসলমান
রোহিঙ্গাদের জন্য সীমান্ত উন্মুক্ত করে দেওয়ার আবেদন জানাচ্ছে। বাংলাদেশের ভেতরে
ঘটে যাওয়া অনেক সাম্প্রদায়িক অঘটনের ব্যাপারে এ গোষ্ঠীটিকে নির্লজ্জ নীরবতা
অবলম্বন করতেই শুধু দেখা যায় না, বরং এসব
ঘটনায় ইন্ধন দেওয়ার অভিযোগও তাদের বিরুদ্ধে শোনা যায়। আরেকটি গোষ্ঠী ১৯৭১ সালে
বাংলাদেশি শরণার্থীদের ভারতে আশ্রয় নেওয়ার উদাহরণ টেনে সীমান্ত উন্মুক্ত করে
দেওয়ার দাবি জানাচ্ছে।
ক্ষমতা থেকে দূরে থাকার সুবাদে সীমান্ত খুলে দেওয়ার পরবর্তী পরিস্থিতি
সামাল দেওয়ার দায় থেকে মুক্ত থাকাই এ ধরনের আপাত-মানবিক দাবির সূত্র কি না তা ভেবে
দেখার অবকাশ আছে।
আরেকটি গোষ্ঠী সীমান্ত খুলে দেওয়ার উপরোধ নিয়ে প্রতিবারই হাজির হয়, সেটি হলো আন্তর্জাতিক মানবতাবাদী গোষ্ঠী। যে ধরনের আবেগী আগ্রহাতিশয্য নিয়ে তাদের বাংলাদেশের
প্রতি নসিহত বর্ষণ করতে দেখা যায়, তার খণ্ডাংশ ঘটনার মূল হোতা
মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে প্রযুক্ত হলে এত দিনে পরিস্থিতির সমূহ উন্নতি ঘটতে
পারত। আরেকটি গোষ্ঠী আছে, যারা রোহিঙ্গাদের এ দেশে ঢুকতে দেওয়ার ঘোর বিরোধী। ক্ষমতাসীন দলের অতি
উৎসাহী সমর্থকদের মধ্যে সুলভ এ গোষ্ঠীর বক্তব্য সময়ে সময়ে এতটাই বর্ণবাদী ও অতি
স্বাজাত্যবাদী সাধারণীকরণ দোষে দুষ্ট হয়ে ওঠে যে এদের সভ্য সমাজের অংশীদার বলে
ভাবতেও কুণ্ঠা হয়। এদের ভাষ্যমতে, রোহিঙ্গা মাত্রই; হোক সে নারী, বৃদ্ধ বা শিশু; জঙ্গি, অপরাধী, চোরাচালানি, মাদক বা অস্ত্র ব্যবসায়ী ইত্যাদি।
বার্মা
সরকার দাবি করে, রোহিঙ্গারা
অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশি। ১৯৮২ সালে প্রণীত সিটিজেনশিপ অ্যাক্ট অনুযায়ী সে দেশের
সব নাগরিককে তারা তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করে—পূর্ণ নাগরিক, সহযোগী নাগরিক ও দেশীভূত নাগরিক। রোহিঙ্গাদের এই
তিন শ্রেণির বাইরে রেখে ‘বসবাসকারী
বিদেশি’ আখ্যা
দিয়ে বিশ্বের অল্প কিছু রাষ্ট্রবিবর্জিত জনগোষ্ঠীর একটিতে পরিণত করা হয়। কিন্তু
আসলেই কি রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে অনুপ্রবেশকারী? এ রকম একটি মত সে দেশের কর্তৃপক্ষ ও বিবদমান কিছু
জাতিগোষ্ঠী দাবি করে থাকলেও ইতিহাসবিদরা তাদের উৎস সম্পর্কে বেশ কিছু ভিন্নতর
মতবাদ উপস্থাপন করেছেন। অনেকের মতে, তারা রাখাইন রাজ্যের আদি বাসিন্দা, যে এলাকাটি ১৭৮৪ সাল
পর্যন্ত আরাকান রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। অনেকে বলেন, তারা আদি বাসিন্দা নয়, তবে আরাকান রাজ্য একটি
সমৃদ্ধ অঞ্চল হওয়ার সুবাদে যুগে যুগে বঙ্গসহ নানা এলাকার মানুষ সেখানে
ভাগ্যান্বেষণে গিয়ে স্থায়ী হয়, তবে তা
কয়েক শতাব্দী আগের কথা। আরেকটি মতবাদ হলো, তারা অষ্টম-নবম শতকে নৌপথে ব্যবসা করতে আসা আরব
বণিকদের বংশধর। এ ছাড়া ১৮২৪ থেকে ১৯৪৮ সালে যখন মিয়ানমার ব্রিটিশদের অধিকারে ছিল, রোহিঙ্গারা সেই সময়
ব্রিটিশদের আনুকূল্যে বসতি স্থাপনকারী হিসেবেও চিহ্নিত। কাজেই বেশির ভাগ মতবাদ
অনুযায়ী রোহিঙ্গারা ঠিক বর্তমান সময়ের অনুপ্রবেশকারী নয়, বরং তারা হয় ভূমিপুত্র, না হয় সুদূর অতীতে
বসতি স্থাপনকারী।
বাংলাদেশে
বৈধ-অবৈধভাবে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের অবৈধভাবে ভোটার তালিকাভুক্ত করে রাজনৈতিক
ফায়দা হাসিলের অভিযোগ উঠেছে জোরেশোরে। মৌলবাদী জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো অসহায়ত্বের সুযোগ
নিয়ে তাদের যে দলে ভেড়াচ্ছে না তারই বা নিশ্চয়তা কী? ২০১২ সালে রামুতে বৌদ্ধমন্দির লুণ্ঠনের ঘটনায়
রোহিঙ্গাদের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণও পাওয়া গিয়েছে। রোহিঙ্গাদের কারণে বাংলাদেশের ওপর
অর্থনৈতিক চাপের বিষয়টি আলোচিত হলেও এ সংকটের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, স্বাস্থ্যগত দিকটি
এখনো রয়ে গেছে অনুচ্চারিত, অনালোচিত।আবেগ
একটি মানবিক গুণ। ব্যক্তিজীবনে এ গুণের কদর যেমন আছে, প্রয়োজনও আছে।
রাষ্ট্রীয়
সিদ্ধান্ত গ্রহণে অবিমৃশ্য আবেগের ঊর্ধ্বে উঠে তত্ত্ব ও তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত
গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। আমরা চাই বাংলাদেশ বিশ্বদরবারে একটি মানবিক রাষ্ট্র
হিসেবে চিহ্নিত হোক, সম্মানিত
হোক। কিন্তু নিজ দেশের মানুষের কল্যাণ জলাঞ্জলি দিয়ে বহিরাগতদের আশ্রয় দেওয়াটা কি
মানবিকতা? তার চেয়ে
বড় কথা, এ দেশে
আশ্রয় নিয়েও কি রোহিঙ্গারা ভালো থাকতে পেরেছে বা পারবে? উপরন্তু তাদের জন্য
সীমান্ত খুলে দিলে মিয়ানমার সরকারকে নিজ জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অত্যাচার আর অবিচার
করাকে প্রশ্রয় ও উৎসাহ দেওয়া হবে না কি? তাহলে কী করবে বাংলাদেশ সরকার; নারী-শিশু-বৃদ্ধসহ
আশ্রয়প্রার্থী অসহায় রোহিঙ্গাদের মুখের ওপর সীমান্ত বন্ধ করেই কি সে সারবে তার
মানবিক দায়িত্ব? আমি মনে
করি, বাংলাদেশ
সরকারের জন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজের মানবিক মুখটিকে উজ্জ্বল করার এ-ই মোক্ষম
সুযোগ। শরণার্থীদের যাওয়ার জায়গা তিনটিই—নিজ দেশ, উদ্দিষ্ট দেশ, আর তৃতীয় দেশ। বাংলাদেশ সরকারের আশু কর্তব্য হবে
আন্তর্জাতিক কমিউনিটির মধ্যে থার্ড কান্ট্রি রিসেটেলমেন্ট বিষয়ে ডিপ্লোমেটিক
নেগোসিয়েশনের নেতৃত্ব গ্রহণ করা। এ পদ্ধতিতে সিরীয় শরণার্থীদের সমস্যার কিছুটা
হলেও সমাধান হয়েছে, রোহিঙ্গাদেরও
হতে পারে। তাই নিজ দেশে আশ্রয় দেওয়া নয়, মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো তো নয়ই।প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনার নেতৃস্থানীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা। এতে যেমন রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকটের
স্থায়ী ও মানবিক সমাধান হতে পারে, একই
সঙ্গে বাংলাদেশের নামও বিশ্ব দরবারে মর্যাদা ও সম্মানের সঙ্গে উচ্চারিত হবে।
রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে বাংলাদেশের পদক্ষেপ:
Ø
আর কোন রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না
দেয়া।
Ø
যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আছে, তাদের তালিকা তৈরী করা
ও কড়া নজরদারীর ব্যবস্থা করা। রোহিঙ্গা নীতিমালা প্রণয়ন করা;যার মাধ্যমে উদ্বাস্তু
রোহিঙ্গাদের কি কি সুবিধা বাংলাদেশ সরকার প্রদান করবে, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে
থাকতে হলে কি কি বিধিমালা মেনে চলতে হবে, তার উল্লেখ থাকবে।
Ø
যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আছে,তাদের পর্যায়ক্রমে
আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায় ও সংগঠনের সহায়তায় মায়ানমারে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা।
এছাড়া, রোহিঙ্গা
রিফিউজিদের তৃতীয় কোন দেশে প্রেরণের বিষয়ে প্রচেষ্টা চালানো।
Ø
আর্ন্তজাতিক ও স্থানীয়ভাবে মায়ানমার সরকারের উপর
চাপ সৃষ্টি করা,যাতে
মায়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে এবং আরাকানের উত্তরাঞ্চলে
স্বায়ত্বশাসন দেয়।
Ø
রোহিঙ্গাদের জন্য পূর্ণাঙ্গ পূর্নবাসন কর্মসূচী
হাতে নেয়া।রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের মায়ানমারে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা।
Ø
ঐতিহাসিকভাবে এটা প্রমাণিত যে, রোহিঙ্গারা
আরাকানের স্থায়ী অধিবাসী। তাই, মায়ানমার সরকারের
উচিত রোহিঙ্গাদের পূর্ণাঙ্গ নাগরিকত্ব প্রদান করা।বাংলাদেশের উচিত সমগ্র বিশ্বকে
বিষয়টি সম্পর্কে অবগত করা।যদি বিশ্বকে করা সম্ভব না হয় তবে পার্শ্ববর্তী দেশসমূহ
নিয়ে রোহিঙ্গা অধিকার আদায়ে সম্পৃক্ত হওয়া উচিত।
Ø
আমদের সরকার কিছু করতে পারবে না কারন বাংলাদেশের সরকারের ঘাড়ে এখন প্রায় ১৭
কোটি উর্ধ জনগনের ভার। যাদের মানবতার নিশ্চয়তা কোন সরকারই এখনো প্রতিষ্টা করতে
পারেনি। পেপার খুললেই বাংলাদেশের জনগনের মানবতা বিপন্ন হওয়ার নমুনা দেখা যায়।
সেই সাথে আছে ১৯৭৮/১৯৯১-২ সালে মানবতা দেখানোর ফলাফল ২৯০০০ রেজিস্টারকৃত আর ২০০০০০
পলাতক রোহিঙ্গা। তাই যে দেশের কোনও সরকার আজো পর্যন্ত তাঁর নিজের জনগনের মানবতা রক্ষা করতে
সামর্থ হয়নি সেই দেশের সরকারের কাছে আবার বাইর থেকে মানবতা ধার করে আনার কথা আশা
করা মুর্খতা বই কিছু না।
উপসংহার :
যেকোন দেশের সংকটে অবশ্যই পাশে থাকা উচিত। কিন্তু রোহিঙ্গা সংকট মায়ানমার সরকার এবং সেনাবাহিনীর নিজস্ব তৈরি বিপর্যয়। যার ফল ভোগ করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। এই ব্যাপক সংখ্যক সহায়-সম্বলহীন জনগণের আশ্রয় দিতে যেমন অতিরিক্ত খাদ্য,বস্ত্র, বাসস্থানের প্রয়োজন। সেই সাথে এরা আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার পথেও বাঁধা হতে পারে যেকোনো সময়। তাই বিশ্ব সম্প্রদায়ের দ্বারা মায়ানমারের উপর চাপ সৃষ্টি করে শান্তিপূর্ণ সমাধানের মাধ্যমে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে তাদের নিজের দেশে ফেরত পাঠানো অতীব প্রয়োজনীয়।